সরেজমিনে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার রবীন্দ্র পল্লীর ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। অভিযোগ উঠেছে, এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি ‘হ্যাক’ করে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত রবিবার হিন্দু পল্লীতে হামলা চালানো হয়।
লক্ষ্মী রানী জানান, ঘটনার সময় তার ছেলে, মেয়ে ও স্বামী কেউ বাড়িতে ছিলেন না। হঠাৎ করে একদল যুবক লাঠিসোটা নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলা শুরু করে। সে সময় ভয়ে পালিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। আর সেই বাড়ির জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনেই নিজের হাতে সাজানো-গোছানো সংসার তছনছ হয়ে যাওয়া দেখেন! দেখেন ঘরের আসবাবপত্রে আগুন দেয়া, মালামাল ভাঙচুরসহ লুটপাট করা। বলতে বলতেই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল লক্ষ্মী রানীর।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে রবীন্দ্র পল্লী ভাওয়াল বাড়ি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। পরে ওই ভাওয়াল বাড়ির ৯টি বাড়ি ঘরে চলে ভাঙচুর লুটপাট।’
সরেজমিনে ভাওয়াল বাড়িতে গেলেও প্রথমে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মন্দিরের ভেতরে ভাঙচুর করা মালামাল আর প্রতিমা। ওই মন্দিরের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক সত্য প্রসাদ দাসের ঘরে যেতেই দেখা যায়, ভাঙচুর করা আসবাবপত্র, যা এখনও এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে।
শিক্ষকের স্ত্রী অঞ্জু রানী দাস জানান, তিনি তার নাতিদেরকে খাওয়াচ্ছিলেন এবং বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। হঠাৎ করে চার যুবক ২টি জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করতে থাকে। বাধা দিতেই তাদের হাতে থাকা কাঠের টুকরো দিয়ে তাকে মারধর করে। স্বামী এসে বাধা দিলে তাকেও মারধর করে হামলাকারীরা।
বাসায় থাকা টাকা-পয়সা ও স্বর্ণলংকার লুট করে নেয়া হামলাকারী যুবকদের পড়নে জিন্সপ্যান্ট ও পাঞ্জাবি থাকলেও তাদের কাউকে চিনতে পারেননি বলে জানান অঞ্জু রানী।
প্রতিবেশী সুবল দাসের পাশের ঘরে থাকা মেয়ে মঞ্জরী দাস জানান, তারা গেটে তালা লাগিয়ে ভেতরে অবস্থান করছিলেন। তারপরও তাদের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ঘরের জানালা ভাঙচুর করা হয়।
দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের অনেক বর্বরতার কথা শুনেছি। কিন্তু এখন এমন বর্বরতা ঘটবে ভাবতে পারিনি।’
কলেজ ছাত্রী প্রমী দাস বলেন, ‘আমাদেরতো কোন দোষ ছিলো না। তারপরও অকথ্য ভাষায় আমাদের গালিগালাজ করেছে হামলাকারীরা। যার জন্য রাতে আমারা ঘুমাতে পারি না।’
আরেক প্রতিবেশী কাজল চন্দ্র দে’র ঘরের সামনে গেলে দেখা যায় পাশের ঘরের আরও এক সংখ্যালঘু রাজিব রতনের মোটরসাইকেল পোড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাদের ঘরেও একই অবস্থা।
একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মনিক্ষী রানী জানান, তিনি অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ির দরজার সামনে মন্দিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন রাস্তা দিয়ে মিছিল যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একদল মন্দিরে ভাঙচুর করতে থাকে। তিনি ভয়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে দরজা আটকে দেন। কিন্তু হামলাকারী দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ঘরের মালামাল ভাঙচুর করে চলে যায়।
তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার সময় দেশে হিন্দু মুসলিম এক সাথে যুদ্ধ করেছিল। এখন তারা বলে এটা আমাদের দেশ না। কিন্তু কেন? আমরাতো আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে থাকি। কিছু হলেই আমাদের উপর হামলা চালায় কেন? কি অপরাধ ছিলো আমাদের?’
এদিকে ভাওয়াল বাড়িসহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিদর্শন করে হিন্দু বৌদ্দ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভোলা জেলা আহবায়ক অবিনাশ নন্দি বলেন, ‘অভিযুক্ত বিপ্লব যদি দোষী হয় তার বিচার আমরাও চাই। কিন্তু প্রমাণের আগে কেন এই বর্বর হামলা চালানো হলো।?’
‘যে কুচক্রী মহল ভোলায় এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পেছনে জড়িত, তাদেরকে অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
এদিকে সংখ্যালঘু পরিবার ও মন্দিরে হামলার ঘটনা পরও শুধু ওই ভাওয়াল বাড়ি নয় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে বোরহানউদ্দিন উপজেলার সংখ্যালঘু পরিবারগুলো। কিন্তু এ ঘটনার সাথে জড়িত হামলাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
ঘটনার দুদিন পর মঙ্গলবার রাতে বোরহানউদ্দিন থানায় ৪/৫ শত অজ্ঞাতকে আসামি করে মামলা হয়েছে জানিয়ে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি এনামুল হক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি।’
এছাড়া বোরহানউদ্দিনের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়সীমা বুধবারই শেষ হওয়ায় আরও দুদিন সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান ভোলা জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক মাহামুদুর রহমান।
প্রসঙ্গত, বিপ্লব চন্দ্র শুভ’র নিজের নাম ও ছবি সম্বলিত ফেসবুক আইডি থেকে মহানবীকে (স.) অবমাননা করে কয়েকজনকে ম্যাসেজ দেয়া হয়। কিন্তু ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে বলে থানায় জিডিও করেছিল বিপ্লব।
এদিকে ফেসবুকের ম্যাসেজগুলো ভাইরাল হলে বোরহানউদ্দিনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে বোরহানউদ্দিনের ঈদ গাহ মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশের শেষ পর্যায়ে পুলিশ ও মুসল্লিদের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। অপরদিকে এ সংঘর্ষ চলাকালে একটি গ্রুপ বোরহানউদ্দিনের ভাওয়াল বাড়িসহ হিন্দু পল্লীতে হামলা চালায়।